মাগুরা জেলা প্রশাসনের পটভূমি
গঙ্গার প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গরাষ্ট্রে সভ্যতা বিস্তৃত হয়। ক্রমে ক্রমে মিথিলা, পৌন্ড্রবর্ধন ও বঙ্গ প্রভৃতি দেশে আর্যগণের উপনিবেশ স্থাপিত হতে থাকে। আজকের মাগুরা জেলা যে সীমানা নিয়ে গড়ে ওঠেছে তার পিছনে ভাগিরথী ও পদ্মার বিভিন্ন শাখা বা প্রশাখা ভাঙ্গা গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। সাবেক ও বর্তমানে মধুমতি/গড়াই, কুমার, নবগঙ্গা, চিত্রা, ফটকি/যদুখালী, হানু, মুচিখালী ও ব্যাঙ নদী বিধৌত এই মাগুরা জেলা। মুচিখালী ও গড়াই সঙ্গম স্থলে নবগঙ্গা তীরে ঝিনাইদহ হতে সতেরো মাইল পূর্বে মাগুরা। প্রাচীন বুড়োল দ্বীপ ও গঙ্গা দ্বীপের অধীন এই ভূ-খন্ডটি বিজয় সেনের আমলে বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত এলাকা ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে কুমার নদীর মোহনায় মাগুরা জেলার প্রথম জন বসতি শুরু হয়েছিল। ভারত বর্ষে বাংলা প্রদেশে পরীক্ষামূলকভাবে ১৭৮১ সালে প্রথম জেলা হিসেবে যশোরকে ঘোষণা করা হয়। মাগুরা তখন যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহকুমা স্থাপনের আগে মাগুরা খ্যাত ছিল না। রেনেলম্যাপে মাগুরা বড় অক্ষে চিহ্নিত। অতীতের নথিপত্রে কোথাও মাগুরার উজ্জলতার চিহ্ন দেখা যায়না। নদীর সঙ্গমস্থল মাগুরা ছিল অপরাধের জন্য উপযুক্ত স্থান। এই অঞ্চলে এক সময় মগ জলদস্যুদের উৎপাতে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। আর তাই এই দস্যু, তস্করদের হাত থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষার্থে, প্রকৃতপক্ষে খ্যাতির জন্য নয়, ডাকাতির মত অপরাধ দমনের ব্যবস্থা নিতে মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ঐ সময় মাগুরাতে কোন থানাও ছিল না। মহকুমা স্থাপনকালে প্রথমে পুলিশফাঁড়ি ও পরে থানা স্থাপন করা হয়। ১৮৪৫ সালে মাগুরা মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলেও মাগুরা সদরে থানা স্থাপিত হয় আরও অনেক পরে, ১৮৭৫ সালের ১৬ নভেম্বর । অবশ্য এর আগে ১৮৬৭ সালে শালিখা, ১৮৭৯ সালের ২৮ শে জানুয়ারি শ্রীপুর এবং ১৮৬৯ সালের ২৪ নভেম্বর মহম্মদপুর থানা স্থাপিত হয়। এই চারটি থানা নিয়ে প্রায় ১৪০ বছর মাগুরা যশোর জেলার একটি মহকুমা হিসেবে বজায় থাকে।
মাগুরা মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মিঃ কর্কবার্ণ ছিলেন প্রথম মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট। মাগুরা নিচু এলাকা থাকায় সহসাই জলমগ্ন হয়ে পড়ত। সামান্য উচু এলাকার এক অংশে হাট বসত এবং বাকী অংশে ছিল গ্রাম। কর্কবার্ণ গ্রামবসাীদের উচ্ছেদ করে অন্যত্র হাট বসানোর নির্দেশ দেন। তিনি বেশ ক’টি পুকুর খনন করে মাগুরা সদর উচু করে এরপর এস.ডি.ও হাতদেন মহকুমা ভবন তৈরীর কাজে। প্রথম প্রশাসনিক ভবনটি বর্তমানে পুলিশ সুপার মাগুরার কার্যালয় সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত ছিল। ভবনটি দৈর্ঘ ১২৩ হাত ও প্রস্থ বারান্দাসহ ১৮ হাত এবং দক্ষণমুখী অবস্থায় ছিল। এই অফিসের আশেপাশের জায়গায় গড়ে উঠে মহাকুমা শহর। পরবর্তিতে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে পাক সরকার কর্তৃক মহকুমা প্রশাসক মোঃ ফজলুল হাসান ইউসুফ সি.এস.পি সাহেবের সময় ১৯৬৮ সালে কলেজ রোডের পূর্ব পার্শ্বে বর্তমান স্থানে মহকুমা প্রশাসকের অফিসটি পুনঃস্থাপিত হয়।
প্রায় তিন দশকের অধিককাল সাবেক মহকুমা অফিসটি পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং নামে পরিচয় নিয়ে অতীত স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিত। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত এই অফিস ভবনে একাধিক অফিসের কাজ চলত। পুলিশ সুপারের অফিস ভবন নির্মানের সময় মহকুমা প্রশাসকের এ অফিস ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এ একতলা ভবনটিতে সকল মহকুমা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো এবং ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ মাগুরা মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার পর মহকুমা প্রশাসকের এই অফিসটিই জেলা প্রশাসকের অফিসে পরিনত হয়।
পরবর্তিতে ১৯৯৮ সালে পুরাতন অফিস ভবনের সামনে জেলা প্রশাসকের অফিস ভবনের কাজ শুরু হয়। ২০০২ সালে নতুন ভবন নির্মিত হলে প্রশাসনের কার্যক্রম নতুন তিনতলা ভবনে স্থানান্তর হয় এবং প্রশাসনের সকল কার্যক্রম বর্তমানে এখান থেকেই পরিচালিত হচ্ছে।
নামকরণের ইতিহাস
মাগুরার নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।‘‘ খুলনা শহরের আদিপর্ব’’ গ্রন্থের লেখক ঐতিহাসিক আবুল কালাম সামসুদ্দিনের মতে, মরা গাঙ থেকে মাগুরা নামের উৎপত্তি। মরা গাঙ আঞ্চলিক ভাষায় মরগা বলে প্রচলিত। অনেকের মতে ধর্মদাস নামক জনৈক মগ জলদস্যু মাগুরার পার্শ্ববর্তী মধুমতি নদী সংলগ্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে। মগদের অত্যাচারে এলাকার লোকজন অতিষ্ট হয়ে পড়ে এবং তারা বিতাড়িত হয়। সেই মগ ও মরগা থেকে ‘মাগুরা’ নামের উৎপত্তি। তবে এখনও জনশ্রুতি প্রচলিত যে, মাগুরার খাল বিলে এক কালে প্রচুর মাগুর মাছ পাওয়া যেত। আর সেই মাগুর মাছের প্রসিদ্ধি থেকে ‘‘মাগুরা’’ নামকরণ হয়েছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস